৪৭তম বিসিএস প্রিলিমিনারি প্রস্তুতি: বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষা দেশের তরুণ গ্র্যাজুয়েটদের জন্য এক স্বপ্নের নাম। কাঙ্ক্ষিত সরকারি চাকরি লাভের প্রথম ধাপ হলো বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা। সবকিছু ঠিক থাকলে ৪৭তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা আগামী ৮ আগস্ট (সম্ভাব্য) অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এই অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় প্রায় সাড়ে ৩ লাখ চাকরিপ্রার্থী অংশগ্রহণ করবেন, যেখানে পিএসসির পূর্ববর্তী ধারা অনুযায়ী মাত্র ১৫ থেকে ২০ হাজার প্রার্থী প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হতে পারবেন। এই সীমিত সংখ্যক আসনে নিজের নাম লেখাতে হলে প্রয়োজন একটি কৌশলগত এবং সুপরিকল্পিত প্রস্তুতি।
৪৭তম বিসিএস প্রিলিমিনারি প্রস্তুতি
৪৭তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার জন্য বিষয়ভিত্তিক প্রস্তুতিকে আরও শাণিত করতে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন ৪১তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারপ্রাপ্ত মো. মাসুম কামাল। তাঁর পরামর্শগুলো নিচে বিস্তারিত তুলে ধরা হলো:
সাধারণ প্রস্তুতি নির্দেশনা
বিসিএস প্রিলিমিনারিতে সফলতার জন্য কিছু সাধারণ বিষয় মেনে চলা জরুরি:
- সিলেবাস অনুযায়ী পড়তে হবে: প্রস্তুতির শুরুতে অনেকেই এক সেট গাইড বই কিনে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মুখস্থ করা শুরু করেন। এটি একটি ভুল পদ্ধতি। এতে অপ্রয়োজনীয় অনেক তথ্য পড়ায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো মনে রাখতে সমস্যা হয় বা পরীক্ষার হলে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। তাই কৌশলগত প্রস্তুতির জন্য প্রথমে পিএসসির ওয়েবসাইট থেকে ৪৭তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি সিলেবাস ডাউনলোড করে নিতে হবে। এরপর প্রত্যেকটি সাবজেক্ট সিলেবাসের টপিক ধরে ধরে বুঝে বুঝে পড়তে হবে। এতে স্বল্প সময়ে অধিক কার্যকর প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব।
- নিয়মিত রিভিশন: যা পড়বেন, তা নিয়মিত বিরতিতে রিভিশন করা অত্যন্ত জরুরি। রিভিশন না করলে পড়া মনে রাখা কঠিন হয়।
- প্রচুর এমসিকিউ অনুশীলন: বিষয়ভিত্তিক পড়া শেষ হওয়ার পর প্রচুর পরিমাণে এমসিকিউ অনুশীলন করতে হবে। এতে প্রশ্ন পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা তৈরি হবে এবং আত্মবিশ্বাস বাড়বে।
- মডেল টেস্ট: প্রস্তুতির শেষ দিকে এসে নিয়মিত মডেল টেস্ট দেওয়া উচিত। এতে পরীক্ষার পরিবেশের সাথে পরিচিত হওয়া যায় এবং নিজের প্রস্তুতি যাচাই করা যায়।
- নেগেটিভ মার্কিংয়ে সতর্ক: বিসিএস প্রিলিমিনারিতে নেগেটিভ মার্কিং রয়েছে। তাই পরীক্ষার হলে যে প্রশ্নগুলো সম্পর্কে আপনি শতভাগ নিশ্চিত নন, সেগুলো দাগানো থেকে বিরত থাকুন। কনফিউশন নিয়ে উত্তর করলে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি এবং এতে প্রাপ্ত নম্বর থেকে কাটা যায়, যা পাশের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়।
বিষয়ভিত্তিক প্রস্তুতি কৌশল
মো. মাসুম কামাল ৪৭তম বিসিএস প্রিলিমিনারির জন্য বিষয়ভিত্তিক প্রস্তুতির যে পরামর্শ দিয়েছেন, তা নিচে দেওয়া হলো:
- বাংলা (২৫ নম্বর):
- প্রথমে বিগত ৪৫তম থেকে ১০তম বিসিএসের বাংলা প্রশ্নগুলো ভালোভাবে বুঝে পড়ুন। যেকোনো ভালো মানের প্রশ্নব্যাংক ব্যবহার করতে পারেন।
- সাহিত্য অংশের জন্য যেকোনো একটি নির্ভরযোগ্য গাইড বই থেকে প্রাচীন যুগ, মধ্য যুগ এবং আধুনিক যুগের গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক ও তাদের রচনাসমূহ ভালোভাবে পড়ুন। বিগত বিসিএস ও অন্যান্য সরকারি চাকরির পরীক্ষায় আসা প্রশ্নগুলোকে বেশি গুরুত্ব দিন।
- ব্যাকরণ অংশের জন্য ৯ম-১০ম শ্রেণির বাংলা ব্যাকরণ বোর্ড বইটি ভালোভাবে পড়ুন। ভাষা, শব্দ (প্রকারভেদ, সমার্থক, বিপরীতার্থক, দ্বিরুক্ত, পারিভাষিক), ধ্বনিতত্ত্ব, ধ্বনির পরিবর্তন, ণ-ত্ব ও ষ-ত্ব বিধান, সন্ধি, সমাস, কারক ও বিভক্তি, পদ প্রকরণ, উপসর্গ, প্রকৃতি ও প্রত্যয়, বাক্য প্রকরণ, যতি ও ছেদ চিহ্ন, গুরুত্বপূর্ণ বাগধারা, এককথায় প্রকাশ (বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় আসাগুলো) টপিকগুলো ভালোভাবে আয়ত্ত করুন।
- গাইড বই থেকে এই টপিকগুলোর বিগত চাকরির পরীক্ষার প্রশ্ন ও সম্ভাব্য প্রশ্ন অনুশীলন করুন।
- ইংরেজি (৩৫ নম্বর):
- প্রস্তুতির শুরুতে বিগত বিসিএসের প্রশ্নগুলো ভালোভাবে বুঝে পড়ুন।
- গ্রামার অংশে ২০ নম্বর থাকে। Tense, Sentence, Article, Parts of Speech, Right form of verbs, Subject Verb Agreement, Voice & Narration, Correction সহ গুরুত্বপূর্ণ গ্রামার রুলসগুলো বুঝে বুঝে পড়ুন এবং প্রচুর অনুশীলন করুন। যেকোনো ভালো লেখকের বই বা শিক্ষকের সহায়তা নিতে পারেন।
- Number & Gender, Preposition, Phrase & Idiom, Group Verb, Synonym & Antonym এর জন্য বিগত বিসিএস ও বিভিন্ন সরকারি চাকরির পরীক্ষায় আসা প্রশ্নগুলো ব্যাখ্যাসহ পড়লে কমন পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
- ভোকাবুলারির জন্য যেকোনো ভালো ভোকাবুলারির বই থেকে গুরুত্বপূর্ণ শব্দের অর্থ, সিনোনিম, অ্যান্টোনিম মুখস্থ করুন।
- সাহিত্য অংশে ১৫ নম্বর থাকে। সিলেবাস দেখে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক, বিশেষ করে শেক্সপিয়ার, ক্লাসিক্যাল পিরিয়ড, রোমান্টিক পিরিয়ড, মডার্ন এবং পোস্ট মডার্ন পিরিয়ডের গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক ও তাদের রচনা ভালোভাবে পড়ুন। বিগত বিসিএস ও বিভিন্ন সরকারি চাকরির পরীক্ষায় আসা প্রশ্নগুলো বারবার অনুশীলন করুন।
- গাণিতিক যুক্তি (১৫ নম্বর):
- প্রথমে বিগত বিসিএসে আসা সব অঙ্ক বুঝে বুঝে সমাধান করুন। এতে প্রশ্ন ধরন সম্পর্কে ধারণা হবে।
- সাধারণত ৮ম, ৯ম ও ১০ম শ্রেণির গণিত বইয়ের সিলেবাস সংশ্লিষ্ট টপিক থেকে প্রশ্ন আসে। তাই বোর্ড বইয়ের সিলেবাস সংশ্লিষ্ট সব টপিকের অঙ্কগুলো বুঝে বুঝে করুন।
- যাদের বেসিক দুর্বল, তারা বেসিক ম্যাথ বই দেখতে পারেন বা গণিতে দক্ষ কারো সহযোগিতা নিতে পারেন।
- দ্রুত অঙ্ক করার জন্য এবং এই অংশে ভালো করার জন্য নিয়মিত অনুশীলনের বিকল্প নেই।
- মানসিক দক্ষতা (১৫ নম্বর):
- এই অংশে প্রশ্ন রিপিট হওয়ার প্রবণতা বেশি। তাই প্রথমে বিগত বিসিএস প্রিলিমিনারি এবং লিখিত পরীক্ষার মানসিক দক্ষতার প্রশ্নগুলো ভালোভাবে সমাধান করুন। এতে অনেক প্রশ্ন কমন পেতে পারেন।
- এরপর যেকোনো ভালো গাইড বই থেকে সিলেবাস অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট টপিকগুলো বুঝে বুঝে সমাধান করুন। মানসিক দক্ষতার ওপর একটি ভালো বই অনুসরণ করতে পারেন।
- বাংলাদেশ বিষয়াবলি (৩০ নম্বর):
- প্রথমে বিগত বিসিএসের প্রশ্নগুলো পড়ে প্রশ্ন ধরন সম্পর্কে ধারণা নিন।
- যেকোনো একটি ভালো গাইড বই থেকে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এর ইতিহাস, সংবিধান, বাংলাদেশের সরকার ব্যবস্থা, জনসংখ্যা, অর্থনীতি, বাণিজ্য, সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম টপিকগুলো ভালোভাবে পড়ুন।
- সিলেবাস দেখে অন্যান্য টপিকগুলোও পড়ুন এবং যেকোনো গাইড বই থেকে অন্য সরকারি চাকরির পরীক্ষায় আসা প্রশ্নগুলো ব্যাখ্যাসহ অনুশীলন করুন।
- আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি (২০ নম্বর):
- প্রথমে বিগত প্রশ্ন পড়ে সিলেবাস অনুযায়ী প্রস্তুতি শুরু করুন।
- যেকোনো ভালো গাইড বই থেকে ৭টি মহাদেশের গুরুত্বপূর্ণ দেশ, অঞ্চল, ব্যক্তি, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য (নদী, সাগর, মহাসাগর, প্রণালি), বিভিন্ন দেশের বিরোধপূর্ণ অঞ্চল, চুক্তি, আন্তর্জাতিক সংগঠন (জাতিসংঘ, আইএমএফ, ডব্লিউবি, ইইউ ইত্যাদি), পরিবেশ বিষয়ক চুক্তি ও সংগঠন, বৈশ্বিক সভ্যতা, যুদ্ধ এবং সিলেবাস সংশ্লিষ্ট অন্যান্য টপিকগুলো ভালোভাবে পড়ুন।
- এই অংশে সাধারণত সাম্প্রতিক বিষয় থেকে বেশি প্রশ্ন হয়। তাই নিয়মিত পত্রিকা পড়া, মাসিক কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স অনুসরণ করা এবং খবর দেখে বৈশ্বিক তথ্য সম্পর্কে আপডেট থাকা খুব জরুরি।
- ভূগোল (১০ নম্বর):
- বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি ভালোভাবে পড়লে ভূগোলের অনেক অংশই কাভার হয়ে যায়।
- এই বিষয়ে ভালো করার জন্য বিগত বিসিএসের প্রশ্ন এবং ৯ম-১০ম শ্রেণির ভূগোল বইটি ভালোভাবে পড়ুন। পাশাপাশি যেকোনো গাইড বই থেকে সিলেবাস অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট টপিকগুলো পড়তে পারেন।
- বাংলাদেশ, আন্তর্জাতিক ও ভূগোলের টপিকগুলো পড়ার সময় অবশ্যই ম্যাপ দেখে দেখে পড়ুন। নিয়মিত পত্রিকা ও কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স পড়ুন এবং খবর শুনুন।
- বিজ্ঞান (১৫ নম্বর):
- বিজ্ঞান অংশে অনেক প্রশ্ন রিপিট হয়। তাই বিগত বিসিএসের প্রশ্নগুলো ব্যাখ্যাসহ খুব ভালোভাবে পড়ুন।
- ৮ম শ্রেণির বিজ্ঞান বইটি ভালোভাবে পড়ুন।
- এরপর সিলেবাস অনুযায়ী যেকোনো ভালো গাইড বই থেকে সংশ্লিষ্ট টপিকগুলো ভালোভাবে পড়ুন।
- বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় আসা প্রশ্নগুলো ভালোভাবে পড়তে পারলে অনেক প্রশ্ন সরাসরি কমন পেতে পারেন।
- কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি (১৫ নম্বর):
- এই অংশেও শুরুতে বিগত বিসিএসের প্রশ্নগুলো পড়ুন, এতে প্রশ্ন ধরন বুঝতে পারবেন।
- কম্পিউটার সংশ্লিষ্ট মৌলিক বিষয় এবং নতুন তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে ভালোভাবে পড়ুন।
- যেকোনো ভালো গাইড বই থেকে সিলেবাস অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট টপিকগুলো ভালোভাবে পড়ুন।
- বিগত বিসিএস ও বিভিন্ন সরকারি চাকরির পরীক্ষায় আসা প্রশ্নগুলো ব্যাখ্যাসহ ভালোভাবে পড়লে এখান থেকেও প্রশ্ন কমন পেতে পারেন।
- নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সুশাসন (১০ নম্বর):
- এই অংশে ১০ নম্বরের মধ্যে সাধারণত ৪-৫টি প্রশ্ন সহজেই উত্তর করা যায়।
- ভালো প্রস্তুতির জন্য বিগত বিসিএসের প্রশ্ন পড়ার পাশাপাশি যেকোনো গাইড বই থেকে সিলেবাস সংশ্লিষ্ট টপিকগুলো ভালোভাবে পড়ুন।
উপসংহার
৪৭তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা একটি অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক ধাপ। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হলে সিলেবাস অনুযায়ী পরিকল্পিত প্রস্তুতি, নিয়মিত অধ্যবসায়, বারবার রিভিশন এবং প্রচুর অনুশীলনের বিকল্প নেই। মো. মাসুম কামালের দেওয়া এই বিষয়ভিত্তিক পরামর্শগুলো অনুসরণ করলে আপনাদের প্রস্তুতি আরও কার্যকর হবে এবং কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো সহজ হবে। আত্মবিশ্বাস রাখুন, নিয়মিত পড়ুন এবং অনুশীলন করুন। সকলের জন্য শুভকামনা।