প্রথম সিভি তৈরি গাইড: শিক্ষার্থী ও নতুনদের জন্য প্রথম সিভি তৈরির বিস্তারিত গাইড: কখন শুরু করবেন, সিভিতে কী কী বিষয় রাখবেন, কেমন ফরম্যাট ব্যবহার করবেন এবং নিজেকে কীভাবে প্রস্তুত করবেন।
প্রথম সিভি তৈরি গাইড: যা জানা জরুরি
চাকরি, শিক্ষানবিশি (ইন্টার্নশিপ), উচ্চশিক্ষা বা বৃত্তির আবেদন—নানা ক্ষেত্রেই আমাদের প্রয়োজন হয় একটি সিভির (Curriculum Vitae) বা জীবনবৃত্তান্তের। যারা ইতিমধ্যেই ক্যারিয়ারের পথে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছেন, অভিজ্ঞতা যাদের ঝুলিতে জমা হয়েছে, তাদের জন্য সিভিতে লেখার উপকরণ খুঁজে বের করা সহজ। কিন্তু যারা সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু করেছেন বা যাদের পেশাগত অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে, জীবনের প্রথম সিভি তৈরির সময় তাদের মনে অনেক প্রশ্ন আসে। কখন তৈরি করা উচিত, কী কী তথ্য দেওয়া দরকার, কেমন হওয়া উচিত এর ফরম্যাট—এসব বিষয় নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকা স্বাভাবিক। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রভাষক হামিদা মোশাররফ এ বিষয়ে কিছু অত্যন্ত কার্যকর কৌশল জানিয়েছেন, যা নতুনদের জন্য সহায়ক হতে পারে।
প্রথম সিভি কখন তৈরি করব?
অনেকেই মনে করেন, কেবল চাকরির আবেদনের সময় বুঝি সিভির দরকার হয়। কিন্তু এই ধারণা ঠিক নয়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রবেশের পরপরই সিভি তৈরির কৌশলগুলো আয়ত্ত করা উচিত। কারণ সিভি তৈরি করা নিজেই একটি দক্ষতা। এই দক্ষতা নিজে অর্জন না করলে পরবর্তীতে পেশাগত জীবনে পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শুরু থেকেই অর্থাৎ প্রথম বর্ষ থেকেই সিভি তৈরির কথা ভাবা উচিত। শুধুমাত্র চাকরির আবেদন নয়, আন্তর্জাতিক সম্মেলন, বিভিন্ন কর্মশালা, সেমিনার, স্বেচ্ছাসেবী কর্মসূচি বা যেকোনো ধরনের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে গেলেও অনেক সময় সিভির প্রয়োজন হয়। এছাড়া হঠাৎ করে খণ্ডকালীন চাকরির সুযোগও তৈরি হতে পারে। তাই আগে থেকে সিভি প্রস্তুত থাকলে যেকোনো সুযোগের সদ্ব্যবহার করা যায়। প্রথম বর্ষ থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্লাব বা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করুন। এতে আপনার সিভিতে লেখার মতো অভিজ্ঞতা যুক্ত হবে।
সিভিতে কী লিখব এবং কীভাবে নিজেকে প্রস্তুত করব?
জীবনের প্রথম সিভিতে প্রাথমিকভাবে আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি ব্যক্তিগত আগ্রহ, শখ এবং যেকোনো স্বেচ্ছামূলক কাজের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করতে পারেন। ভাষাগত দক্ষতা হিসেবে বাংলা এবং ইংরেজি—উভয় ভাষায় আপনার পারদর্শিতার স্তর যোগ করুন। দ্বিতীয় বর্ষ থেকে পড়াশোনা যখন আরও গভীর হবে, তখন বিভিন্ন কারিগরি কোর্স যেমন রিসার্চ মেথোডলজি, বিজনেস কমিউনিকেশন বা কম্পিউটার দক্ষতা (যেমন মাইক্রোসফট ওয়ার্ড, এক্সেল, পাওয়ারপয়েন্ট, ফটোশপ ইত্যাদি) অর্জনের সুযোগ তৈরি হবে। এসব দক্ষতা অর্জনের পর সিভিতে তা যুক্ত করুন।
সব সিভি এক নয়: প্রয়োজন অনুসারে সাজানো
এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আপনি কোন ধরনের সুযোগের জন্য আবেদন করছেন, তার উপর নির্ভর করে সিভি সাজাতে হবে। ইন্টার্নশিপ, গবেষণা সহকারী বা অনুবাদক—প্রতিটি পদের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা ভিন্ন হয়।
- চাকরির সিভি: এখানে আপনি কী কী কাজ করতে পারেন, বিভিন্ন ক্লাব বা সংগঠনের সাথে আপনার সংশ্লিষ্টতা এবং নেতৃত্বদানের অভিজ্ঞতা থাকলে তা উল্লেখ করতে পারেন। কম্পিউটার দক্ষতা ও ভাষাগত দক্ষতাকে প্রাধান্য দিন।
- গবেষণা সহকারীর সিভি: এখানে গবেষণাসংশ্লিষ্ট ক্লাসওয়ার্ক, ফিল্ডওয়ার্ক বা এই সংক্রান্ত যেকোনো অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দিতে হবে।
- অনুবাদকের সিভি: এক্ষেত্রে আপনার ভাষাগত দক্ষতা এবং এই সংক্রান্ত পূর্বের কোনো অভিজ্ঞতা (যদি থাকে) বিশেষভাবে তুলে ধরতে হবে।
মনে রাখবেন, অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব সিভির ড্রাফট বা ফরম্যাট সরবরাহ করে। কোথাও আবার অনলাইনে একটি ফর্ম পূরণ করতে হয়। তাই যেখানে আবেদন করছেন, সেই প্রতিষ্ঠানের চাহিদা অনুযায়ী আপনার সিভিকে সাজিয়ে উপস্থাপন করা প্রয়োজন। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম যেমন লিংকডইন থেকে বিভিন্ন পেশার মানুষের সিভি দেখে ধারণা নিতে পারেন। এছাড়া আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা ক্যারিয়ার সেন্টারের সাহায্য নিতে পারেন।
যে ফরম্যাট ব্যবহার করব
সিভির কোনো নির্দিষ্ট বা বাঁধাধরা বৈশ্বিক ফরম্যাট নেই। আপনার অভিজ্ঞতা এবং যেখানে আবেদন করছেন তার প্রয়োজন অনুযায়ী সিভি তৈরি করতে হয়। যারা নতুন, তাদের জন্য সাধারণত ২ পৃষ্ঠার সিভিকে আদর্শ হিসেবে ধরা হয়। বয়স এবং অভিজ্ঞতার সাথে সাথে সিভির পৃষ্ঠা সংখ্যা বাড়তে পারে। অন্যের সিভি সরাসরি অনুকরণ না করে বিভিন্ন অনলাইন সোর্স থেকে ধারণা নিয়ে নিজের মতো করে তৈরি করুন। হার্ভার্ড বা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্যারিয়ার সার্ভিসেস বিভাগের দেওয়া সাধারণ সিভি ও কভার লেটার তৈরির ফরম্যাটগুলো নতুনদের জন্য সহায়ক হতে পারে।
সিভিতে যা সংযুক্তির প্রয়োজন নেই
সিভির প্রাথমিক লক্ষ্য হলো আপনাকে সাক্ষাৎকারের জন্য নির্বাচিত হতে সাহায্য করা। তাই অপ্রয়োজনীয় বা অতিরিক্ত তথ্য দিয়ে সিভি ভারাক্রান্ত করার দরকার নেই। আপনার সামগ্রিক তথ্যের একটি সংক্ষিপ্ত ও কার্যকর সারসংক্ষেপই সিভিতে যুক্ত করা উচিত। অপ্রাসঙ্গিক শখ বা অতি ব্যক্তিগত তথ্য পরিহার করুন।
জীবনের প্রথম সিভিতে যা যা থাকবে
একজন শিক্ষার্থী তার জীবনের প্রথম সিভিতে সাধারণত নিচের তথ্যগুলো অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন:
- ব্যক্তিগত তথ্য (Personal Information): আপনার পুরো নাম, যোগাযোগের বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা, ই–মেইল ঠিকানা এবং সক্রিয় মুঠোফোন নম্বর অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে।
- শিক্ষাগত যোগ্যতা (Education): আপনার মাধ্যমিক (SSC), উচ্চ মাধ্যমিক (HSC) এবং বর্তমানে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে, যে বিভাগে, যে বর্ষ/সেমিস্টারে পড়ছেন, তার বিস্তারিত তথ্য (প্রতিষ্ঠানের নাম, পাশের সন/ অধ্যয়নরত, ফলাফল ইত্যাদি) উল্লেখ করুন। পাবলিক পরীক্ষার সংক্ষিপ্ত তথ্য দিতে পারেন।
- অভিজ্ঞতা (Experience): এটি সিভির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যদি কোনো পূর্ণকালীন বা খণ্ডকালীন কাজের অভিজ্ঞতা থাকে, তাহলে তা উল্লেখ করুন। কাজের অভিজ্ঞতা না থাকলে দুশ্চিন্তার কারণ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ক্লাব, সংগঠন বা এক্সট্রা-কারিকুলার অ্যাক্টিভিটির সঙ্গে যুক্ত আছেন, তার নাম, আপনার পদবি (যদি থাকে) এবং সেখানে আপনার কার্যক্রম সম্পর্কে লিখুন। কোনো স্বেচ্ছাসেবী কাজ (Volunteer Work) করে থাকলে তা উল্লেখ করুন।
- দক্ষতা (Skills): আপনার অর্জিত দক্ষতাগুলো এখানে লিখুন। সাধারণভাবে ভাষাগত দক্ষতা (বাংলা ও ইংরেজি) এবং কম্পিউটার দক্ষতা (অপারেটিং সিস্টেম, মাইক্রোসফট অফিস – ওয়ার্ড, এক্সেল, পাওয়ারপয়েন্ট ইত্যাদি) উল্লেখ করতে হবে। সিভির ধরনের ওপর নির্ভর করে ছবি সম্পাদনা (যেমন ফটোশপ), ভিডিও সম্পাদনা বা অন্য কোনো সৃজনশীল কাজে (যেমন আবৃত্তি, গান, খেলাধুলা, ফটোগ্রাফি) আপনার দখল থাকলে তাও যুক্ত করতে পারেন।
- আগ্রহ ও অর্জন (Interests & Achievements): মানুষ হিসেবে কোন বিষয়ে আপনার আগ্রহ আছে বা আপনার শখ কী, তা সংক্ষেপে লিখুন। শিক্ষাজীবনে কোনো উল্লেখযোগ্য অর্জন বা কোনো প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেয়ে থাকলে সেগুলো স্পষ্টভাবে উল্লেখ করুন।
- রেফারেন্স (References): এমন অন্তত একজন পেশাদার ব্যক্তির তথ্য দিন যিনি আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন এবং আপনার দক্ষতা বা যোগ্যতা সম্পর্কে বলতে পারবেন। আপনার কোনো কাজের অভিজ্ঞতা না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক যিনি আপনাকে ভালোভাবে চেনেন, তার অনুমতি নিয়ে নাম, পদবি, প্রতিষ্ঠানের নাম, ই-মেইল এবং ফোন নম্বর রেফারেন্স হিসেবে যুক্ত করতে পারেন।
জীবনের প্রথম সিভি তৈরি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এটি কেবল একটি আবেদনপত্র নয়, বরং আপনার সম্ভাবনাগুলোকে তুলে ধরার একটি সুযোগ। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকেই নিজেকে বিভিন্ন কার্যক্রমে যুক্ত করা, নতুন দক্ষতা অর্জন করা এবং সেই অনুযায়ী সিভি তৈরি করার অভ্যাস গড়ে তোলা ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত ফলপ্রসূ হবে। মনে রাখবেন, প্রতিটি আবেদনের জন্য আপনার সিভিকে নির্দিষ্ট প্রয়োজন অনুযায়ী সাজিয়ে উপস্থাপন করতে হবে। সঠিক পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নিয়ে তৈরি করা প্রথম সিভি আপনার ক্যারিয়ারের দরজা খুলে দিতে পারে।
আরও পড়ুন: বন প্রহরীর কাজ কি? দায়িত্ব, যোগ্যতা, বেতন ও ক্যারিয়ার গাইড
3 thoughts on “জীবনের প্রথম সিভি তৈরির সময় কী কী বিষয় মাথায় রাখা জরুরি: শিক্ষার্থীদের জন্য পূর্ণাঙ্গ গাইড”