কানাডায় ছাত্র রিফিউজি বৃদ্ধি: সাম্প্রতিক সময়ে কানাডায় আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে আশ্রয় (রিফিউজি) আবেদনের সংখ্যা রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছে, যা উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এই সংখ্যা কেবল গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ নয়, বরং ২০১৯ সালের চেয়ে প্রায় ছয় গুণ বেশি। এমন এক সময় এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, যখন কানাডা সরকার আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের স্টাডি পারমিট ইস্যু কমিয়ে আনছে এবং দেশটিতে অস্থায়ী বাসিন্দা ও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এই পরিস্থিতি কানাডায় উচ্চশিক্ষা বা উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখা বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু নতুন চ্যালেঞ্জ এবং করণীয় সামনে নিয়ে এসেছে।
আশ্রয় আবেদনের উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান
কানাডার ফেডারেল ইমিগ্রেশন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে মোট ২০ হাজার ২৪৫ জন বিদেশি শিক্ষার্থী কানাডায় আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেছেন। এই সংখ্যা ২০২৩ সালের আবেদনের প্রায় দ্বিগুণ এবং ২০১৯ সালের তুলনায় ছয় গুণেরও বেশি। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, ২০২৫ সালেও এই সংখ্যা বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকার আশঙ্কা করা হচ্ছে। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই ৫ হাজার ৫০০ জন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী আশ্রয় আবেদন করেছেন, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২২ শতাংশ বেশি।
কানাডার নীতি পরিবর্তন এবং বৃদ্ধির কারণ
কানাডা সরকার বর্তমানে শিক্ষার্থীদের স্টাডি পারমিট প্রদান ৪০ শতাংশ কমিয়ে আনার নীতি গ্রহণ করেছে। এছাড়া, প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি ২০২৭ সালের মধ্যে কানাডার মোট জনসংখ্যার ৫ শতাংশের নিচে অস্থায়ী শ্রমিক ও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কমিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছেন, যা বর্তমানে ৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
এমন নীতির মধ্যেই কেন আশ্রয় আবেদন বাড়ছে? বিশেষজ্ঞদের মতে, এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে:
- স্থায়ী আবাসনের (PR) পথ সীমিত হওয়া: অনেক শিক্ষার্থীর জন্য পড়াশোনা শেষে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ কঠিন হয়ে পড়ছে।
- কাজের অনুমতিপত্র (Work Permit) ও স্পাউস পারমিট পাওয়ার নিয়ম কঠিন হওয়া: পরিবর্তিত নিয়মের কারণে অনেক শিক্ষার্থী এবং তাদের ওপর নির্ভরশীলরা বিপাকে পড়ছেন।
- প্রতারণামূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান: কিছু অসাধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের নিম্নমানের ডিপ্লোমা প্রদান করছে, যা কানাডায় চাকরি বা পিআর পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো কাজে আসছে না।
এই কারণগুলোর সম্মিলিত প্রভাবে অনেক শিক্ষার্থী এখন বিকল্প পথ হিসেবে আশ্রয় প্রক্রিয়ার দিকে ঝুঁকছেন।
কানাডায় অবস্থানরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য পরামর্শ
যারা ইতিমধ্যেই কানাডায় পড়াশোনা শেষ করেছেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাসের আর কোনো সহজ উপায় পাচ্ছেন না, তাদের মধ্যে কেউ যদি আশ্রয় (রিফিউজি) আবেদনের কথা ভেবে থাকেন, তবে কিছু বিষয় অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে:
- আশ্রয় আবেদনের প্রধান ভিত্তি হলো প্রমাণ করা যে আপনার নিজ দেশ বাংলাদেশে আপনার জীবন হুমকির সম্মুখীন। এটি প্রমাণ করা অত্যন্ত কঠিন।
- কানাডা সরকার বর্তমানে হাজার হাজার মিথ্যা আশ্রয় আবেদন বাতিল করে দিচ্ছে।
- ভুল বা মিথ্যা তথ্য দিয়ে আবেদন করলে এটি আপনার জন্য গুরুতর আইনি ঝুঁকি তৈরি করতে পারে এবং ভবিষ্যতে কানাডায় ফেরার পথ স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দিতে পারে।
- এক্ষেত্রে অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ ইমিগ্রেশন আইনজীবীর পরামর্শ নেওয়া অপরিহার্য।
যারা এখনো কানাডায় পড়াশোনা করছেন, তাদের উচিত বর্তমান পরিস্থিতি অনুধাবন করে যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি ও অভিজ্ঞতা অর্জনের দিকে মনোযোগ দেওয়া এবং কানাডার পরিবর্তিত পিআর নীতিগুলো সম্পর্কে সবসময় আপডেট থাকা।
ভবিষ্যতে কানাডায় আসতে আগ্রহী বাংলাদেশিদের জন্য পরামর্শ
যারা ভবিষ্যতে কানাডায় পড়াশোনা বা অন্য কোনো কারণে আসতে আগ্রহী, তাদের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ:
- শুধু কানাডায় আসার উদ্দেশ্যে কোনো নিম্নমানের কলেজ বা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির চিন্তা পরিহার করুন। একটি ভালো ও স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে ভর্তি এবং সুচিন্তিত পরিকল্পনা নিয়ে আসা উচিত।
- কানাডা সরকার এখন শিক্ষার্থী নির্বাচন প্রক্রিয়া অনেক কঠোর করেছে। স্টাডি পারমিট লিমিট, ভেরিফাইড লেটার অব অ্যাডমিশন, পর্যাপ্ত ফান্ড প্রমাণ ইত্যাদি বিষয়গুলো এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- ভবিষ্যতে স্থায়ীভাবে বসবাসের (PR) সুযোগ পেতে হলে আগে থেকেই আপনার কোর্স নির্বাচন এবং অভিজ্ঞতা অর্জনের দিকে মনোযোগ দিন, যা আপনাকে কানাডার শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতামূলক করে তুলবে।
- কানাডার অভিবাসন ব্যবস্থা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি কঠিন ও প্রতিযোগিতামূলক। তাই সঠিক তথ্য, উপযুক্ত পরিকল্পনা এবং বাস্তবমুখী চিন্তা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া অপরিহার্য।
- ভুল তথ্য দিয়ে আশ্রয় আবেদন করলে এটি আপনার কানাডায় থাকার সব পথ বন্ধ করে দিতে পারে।
- মনে রাখবেন, কানাডা তাদের ইমিগ্রেশন সম্পর্কিত সব তথ্য আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যের সাথে আদান-প্রদান করে। তাই কানাডা থেকে কোনো কারণে নিষিদ্ধ (ব্যান্ড) হয়ে গেলে এই চারটি দেশেও আপনার প্রবেশাধিকার সীমিত বা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
উপসংহার
কানাডায় আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের আশ্রয় আবেদন বৃদ্ধি একটি জটিল পরিস্থিতি নির্দেশ করে। এটি একদিকে যেমন পরিবর্তিত অভিবাসন নীতির ফল, তেমনি কিছু শিক্ষার্থী ও প্রতিষ্ঠানের ভুল পদক্ষেপের পরিণতিও বটে। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য এই পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ, নির্ভরযোগ্য তথ্য অনুসরণ এবং কোনো ভুল বা অনৈতিক পথে না যাওয়া অত্যন্ত জরুরি। মনে রাখতে হবে, কানাডায় প্রবেশের ক্ষেত্রে সততা ও সঠিক পদ্ধতি অনুসরণই দীর্ঘমেয়াদী সাফল্যের চাবিকাঠি।
আরও পড়ুন: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৪-২৫ ভর্তি: সাবজেক্ট চয়েস, ভর্তি ও ক্লাস শুরুর নতুন সময়সূচি
1 thought on “কানাডায় আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের আশ্রয় আবেদনের রেকর্ড বৃদ্ধি: কারণ ও বাংলাদেশিদের জন্য করণীয়”